1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

প্রশ্নপত্র ফাঁসের মহামারি বন্ধ করতেই হবে

১৮ আগস্ট ২০২৩

মেধার বদলে প্রশ্নপত্র কিনে একদল শিক্ষার্থী মেডিকেলে ভর্তি হচ্ছেন- এ ঘটনা দেশের স্বাস্থ্যশিক্ষা ব্যবস্থার জন্য ভয়াবহ উদ্বেগজনক৷ সেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে যদি খোদ চিকিৎসকদের জড়িত থাকার তথ্য মেলে, তাহলে উদ্বেগটা আরো বাড়ে৷

https://p.dw.com/p/4VKIS
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ
ছবি: Shahidul Suman

একই সঙ্গে প্রশ্ন ওঠে, ভর্তি পরীক্ষার পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে৷ কারণ, এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়৷ বরং নিয়মিতই এভাবে মেডিকেলের প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে৷

বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) গত ১৩ আগস্ট ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছে, ২০০১ সালের পরবর্তী ১৬ বছরে বাংলাদেশে অন্তত ১০ বার মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে৷ আর সেই প্রশ্নপত্র কিনে অসংখ্য শিক্ষার্থী মেডিকেলে ভর্তি হয়েছে৷ আর এভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছে একটি চক্র৷ এদের মধ্যে ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যার মধ্যে সাতজনই আবার চিকিৎসক৷

২০০১ সালের আগেও দেশে মেডিকেল কলেজের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে৷ মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে মেধায় যারা ভর্তি হতে পারেননি, কিংবা পছন্দের মেডিকেলে সুযোগ পাননি, তাদের জন্য প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবরটা হতাশার৷ সংখ্যায় বেশি বা কম যা-ই হোক, প্রায় নিয়মিতই কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে বলে জানাচ্ছে সিআইডি৷

সিআইডি জানিয়েছে, ২০২০ সালের ২০ জুলাই মিরপুর মডেল থানায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় একটি মামলা হয়৷ মামলাটি তদন্ত করতে গিয়ে ব্যাংক লেনদেনের তথ্য, উদ্ধারকৃত গোপন ডায়েরি এবং তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের বিস্তারিত প্রমাণ মেলে৷ এরপর জসীম উদ্দীন ও আবদুস সালাম নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ তদন্তে জানা যায়, নিয়োগ পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষাসহ নানা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস-চক্রের নেতৃত্ব দেন জসীম৷ আর জসীমের খালাতো ভাই সালাম স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর প্রিন্টিং প্রেসের মেশিনম্যান৷

সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, এই প্রিন্টিং প্রেস থেকে ২০০৬, ২০০৯, ২০১১, ২০১৩ এবং ২০১৫ সালের মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছেন আবদুস সালাম৷ ফাঁস করা সেই প্রশ্নপত্র তার খালাতো ভাই জসীম বিভিন্ন কোচিং সেন্টার এবং তার নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়েছেন৷ এভাবে অনেক শিক্ষার্থী টাকার বিনিময়ে আগে প্রশ্নপত্র পেয়ে মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন৷

এই দুজনেই আদালতে ৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন৷ তাদের জবানবন্দিতে আরো ১২ জনের নাম আসে৷ তবে তারা পলাতক ছিলেন৷ ৩০ জুলাই থেকে ৯ আগস্ট ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে সিআইডি৷

গ্রেপ্তার এই ১২ জনের মধ্যে সাতজনই চিকিৎসক৷ এরা হলেন, ডা. ময়েজ উদ্দিন আহমেদ প্রধান, তার স্ত্রী ডা. সোহেলী জামান, ডা. মো. আবু রায়হান, ডা. জেড এম সালেহীন শোভন, ডা. মো. জোবাইদুর রহমান জনি, ডা. জিল্লুর হাসান রনি, ডা. ইমরুল কায়েস হিমেল৷ এদের বেশিরভাগই বিভিন্ন মেডিকেল ভর্তি কোচিং সেন্টারের মালিক বা প্রাইভেট পড়ানোর সঙ্গে যুক্ত৷

সিআইডি বলছে, গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে ময়েজ উদ্দিন আহমেদ ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন৷ পরে ফেইম নামের কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে মেডিকেলের প্রশ্ন ফাঁস চক্রে জড়ান৷ কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে তিনি অবৈধভাবে শত-শত শিক্ষার্থীকে মেডিকেলে ভর্তি করিয়েছেন৷ তার স্ত্রী, যিনি এখন জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক, তিনিও এই চক্রে জড়িত৷

গ্রেপ্তার আরেকজন, আবু রায়হান ঢাকা ডেন্টাল কলেজের ছাত্র ছিলেন৷ তিনি প্রাইভেট কোচিং সেন্টার চালাতেন৷ আরেকজন জেড এম সালেহীন সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে থ্রি-ডক্টরস নামের কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে মেডিকেল প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত হন৷ গ্রেপ্তার আরেকজন জোবাইদুর রহমান মেডিকো ভর্তি কোচিং সেন্টারের মালিক৷ জিল্লুর হাসান পঙ্গু হাসপাতালের (নিটোর) চিকিৎসক৷ ২০১৫ সালের মেডিকেল পরীক্ষার সময় তিনি রংপুর থেকে একবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন৷

কী ভীষণ দুঃখজনক ঘটনা! মেডিকেল কলেজের প্রশ্নপত্র ফাঁসের চক্রে জড়িতদের বেশিরভাগই চিকিৎসক, যাদের জানার কথা, অযোগ্য লোকেরা ডাক্তার হলে কী হবে! আর সে কারণেই এই তদন্ত এখানেই থেমে থাকা উচিত নয়৷ বরং যারা টাকা দিয়ে প্রশ্নপত্র কিনেছে, তাদের সবাইকে চিহিৃত করে ছাত্রত্ব কিংবা চিকিৎসকের সনদ বাতিল করা দরকার, যাতে এই বার্তাটা প্রতিষ্ঠিত হয় যে, প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্রমে ভর্তি হলে আজ হোক কাল হোক ধরা পড়বেই৷

কেবল মেডিকেল নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও গত কয়েক বছরে একাধিকবার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথম প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে ২০১০ সালের ২১ জানুয়ারি৷ শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইআর)-এর ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষে অনার্স প্রথমবর্ষ ভর্তি পরীক্ষার তিনটি সেটের সবগুলোই ফাঁস হয়৷ ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘ ইউনিটের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়৷ অভিযোগ ওঠে, যেই প্রেস থেকে প্রশ্নপত্র ছাপা হতো, সেখান থেকেই ফাঁস হয়েছে৷ সেই সর্ষের মধ্যেই ভূত৷

সিআইডি জানিয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ও জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০১৯ সালের ২৩ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৭ জন শিক্ষার্থীসহ ১২৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে পৃথক দুটি আইনে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে৷ এর মধ্যে পাবলিক পরীক্ষা আইনে করা মামলাটির বিচার শুরু হয়েছে৷ অপরটি সাইবার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন৷

অন্যদিকে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ও জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ৬৯ জন শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কারের সুপারিশ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা বোর্ড৷ ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত জালিয়াতির মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন এসব শিক্ষার্থী৷

শুধু মেডিকেল বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা নয়, চাকুরির পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নিয়মিতিই ফাঁস হচ্ছে৷ এসব ঘটনায় গত কয়েক বছরে সিআইডি, গোয়েন্দা পুলিশ একাধিক চক্রকে আটক করেছে৷ তাদের অনেকের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার আইনে মামলাও হয়েছে৷ এই তালিকায় সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে ব্যাংকার, ছাত্রনেতা, রাজনীতিবিদসহ নানা পেশার মানুষ আছেন৷

বাংলাদেশে পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ বেশ পুরোনো৷ ১৯৭৯ সালের এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিল বলে জানা যায়৷ ওই ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার জন্য সেই সময় সাভারের সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন), ব্যাংকের এক কর্মকর্তা এবং সাভার অধরচন্দ্র হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষককে দায়ী করা হয়েছিল৷ প্রশ্নপত্রের সিলমোহর করা প্যাকেট কেটে ওই বছর প্রশ্নপত্র ফাঁস করা হলেও শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক কারণে দায়ী ব্যক্তিদের কিছু হয়নি৷ ওই সেই সর্ষের ভূত৷

বিভিন্ন সময় পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ধারাবাহিকতা শুরু ২০০৩ সাল থেকে৷ ২০০২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ওই সময়ের সরকারপন্থি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক পিএসসির সদস্য হিসেবে যোগ দেন৷ এর পর থেকে তার সহায়তায় একাধিক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে৷ ২০০৭ সালের পর অবশ্য পিএসসির ওই সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হয়৷

২০০৯ সালের পর নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ধরন বদলেছে৷ প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও এখন গণহারে সবাই পায় না৷ বরং একটি চক্র আছে, যারা পরীক্ষার কয়েক দিন আগে নির্দিষ্ট প্রার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকা চায়৷ যারা টাকা পরিশোধ করে, শুধু তাদের কাছেই লিখিত উত্তর দেওয়া হয়, কিংবা পরীক্ষার দিনে বা পরীক্ষা চলাকালে ডিভাইসে উত্তর চলে যায়৷

গত কয়েক বছরে এভাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর গোয়েন্দা কর্মকর্তা, সমাজসেবা কর্মকর্তা, খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, অডিট, এটিইও, মেডিকেল, প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা, এসএসসি, এইচএসসি, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাসহ নানা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ধারাবাহিকভাবে ফাঁস হয়েছে৷ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব ঘটনায় অনেককে গ্রেপ্তার করেছে, যাদের অনেকেই সরকারি চাকুরি করেন৷ কিন্তু প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িয়ে তারা বিপুল অংকের অর্থের মালিক হয়েছেন৷ অন্যদিকে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র কিনে চাকুরি পেয়েছেন অনেকে৷

অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বিভিন্ন চাকরি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার আগের রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে শোনা যায় নানা সংকেত৷ ‘‘এই, তুই পাইছিস, ‘কোনো লিংক আছে'', ‘‘কত চায়''—এরকম খুদে বার্তা বিনিময় হয় পরীক্ষার আগের রাতগুলোতে৷ প্রশ্নপত্র পাওয়া যেতে পারে- এই আশায় অনেকে পরীক্ষার আগের দিনই ক্যাম্পাসে চলে আসেন৷ একইভাবে পাবলিক পরীক্ষা হোক সেটি প্রাথমিক, কিংবা এসএসি পরীক্ষার্থীদের অভিভাবকরাও প্রশ্নপত্র খোঁজেন৷ সব মিলিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস এখন বিরাট একটা চক্র৷ এখানে ক্রেতা, বিক্রেতা, দালাল সবই আছে৷ নেই শুধু নীতি নৈতিকতা৷

দুঃখজনক হলো, প্রশ্নপত্র ফাঁস ও ডিজিটাল জালিয়াতির এই চক্রে অনেক সরকারি কর্মকর্তাও জড়িয়ে যাচ্ছেন৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, ছাপা ও বিতরণ থেকে শুরু করে নানা ধাপে যারা কাজ করছেন, তাদের অনেকেই টাকার লোভে প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িয়ে যাচ্ছেন৷

মেডিকেল পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে যেমন ডাক্তাররা জড়িয়েছেন, তেমনি অনেক শিক্ষকও পাবলিক বা নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে যুক্ত৷ এই তো গতবছর দিনাজপুর বোর্ডে এসএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়৷ তদন্তে জানা যায়, একজন শিক্ষক ও কেন্দ্রসচিব, যার দায়িত্ব ছিল নিরাপদে প্রশ্নপত্র পরীক্ষাকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া৷ অথচ তিনি প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছেন৷

কেবল স্কুল শিক্ষক নন, বাংলাদেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে৷ পরে বুয়েটের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধানের পদ থেকে ওই শিক্ষককে অব্যাহতি দেয় কর্তৃপক্ষ৷ একই সঙ্গে তাকে কোনো পরীক্ষায় দায়িত্ব পালন না করারও নির্দেশ দেওয়া হয়৷ আদালতও তাকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছে৷

সর্ষের মধ্যে ভূতের এমন ঘটনা অসংখ্য৷ এই তো গত বছরের ২১ অক্টোবর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ১০টি পদের লিখিত পরীক্ষা ছিল৷ পরীক্ষা শুরুর দেড় ঘণ্টা আগে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ৷ তদন্তে বিমানের এক উপমহাব্যবস্থাপকের বিরুদ্ধেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে৷ জানা যায়, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কয়েকজন একটি সিন্ডিকেট করে নিয়োগপ্রার্থীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে৷ এই ঘটনায় ওই উপমহাব্যবস্থাপকসহ ৩০ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে পুলিশ৷

২০১০ সালে সারাদেশে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা দেশজুড়ে আলোচিত হয৷ সেই ঘটনায় বাংলাদেশ সরকারি প্রিন্টিং প্রেসের (জিপি প্রেস) একজন সহকারী পরিচালকসহ বিজি প্রেসের কয়েকজ কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷

২০২২ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ওই দপ্তরের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে৷ একইভাবে গতবছর নার্সিং কলেজগুলোর পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার ঘটনায় একটি নার্সিং কলেজের সাবেক অধ্যক্ষসহ প্রশ্ন ফাঁস-চক্রের ছয় সদস্যকে আটক করা হয়৷ এর আগে প্রতিরক্ষা মহা-হিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়ের অধীন ‘অডিটর' নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় রাজধানী থেকে বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলা পরিষদের একজন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়৷

অধিকাংশ ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, সর্ষের মধ্যে ভূত৷ যাদের কাজ প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করা, তাদের অনেকেই অর্থের প্রলোভনে প্রশ্নপত্র ফাঁস করছেন৷ এখানে সরকারি নানা কর্তৃপক্ষেরও কিন্তু দায় আছে৷ প্রত্যেকবার প্রত্যেকটা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার পর দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষ সেই অভিযোগ অস্বীকার করে৷ আর সংকটের শুরুটা এখানেই৷ যতোদিন প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগগুলো কর্তৃপক্ষ আমলে না নিয়ে এড়িয়ে যাবে ততোদিন এই চক্র বন্ধ হবে না৷

সাংবাদিকতা জীবনে বহু প্রতিবেদন করেছি, যেখানে সব প্রমাণ থাকার পরেও কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা বাতিল না করে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ অস্বীকার করেছে৷ একটা ঘটনা না বললেই নয়৷ ২০১৭ সালের ১৯ মে সকাল-বিকেল ২ বেলায় অগ্রণী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার পদের নিয়োগ পরীক্ষা ছিল৷ কিন্তু, সকালে পরীক্ষা শুরুর আগেই ব্যাপকভাবে প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে পড়ে৷ এমনকি, পরীক্ষার আগে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রটি আমি সেই সময়ে প্রথম আলো'য় দেওয়ার পরও সেই পরীক্ষা বাতিল করতে চাচ্ছিল না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ৷ এর আগে ওই বছরের ২১ এপ্রিল জনতা ব্যাংকের নির্বাহী কর্মকর্তা পদের লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়৷

অনুসন্ধান করে জানতে পারি, পরীক্ষা শুরুর আগের রাতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্নপত্র ছড়িয়ে পড়ে৷ প্রশ্নপত্র পেয়েছিলেন এমন কয়েকজন বিষয়টা স্বীকারও করেন৷ কিন্তু, ওই পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা সে সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়, কিন্তু পরীক্ষা তো বাতিল হয় না৷ কাজেই এই পরীক্ষাও বাতিল হবে না৷ পরে অবশ্য ছেলে-মেয়েরা আদালতে গেলে সব প্রমাণ দেখে হাইকোর্ট পরীক্ষা বাতিলের নির্দেশ দেন৷

প্রশ্ন হলো, প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ সবসময়ই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করে কেন? কোনো তদন্ত ছাড়াই কী দৈবশক্তিতে তারা এত দ্রুত নিশ্চিত হন যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি? সমস্যাটা এখানেই৷ সবাই দায় এড়াতে চান৷ কিন্তু দায় না নিলে, প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে সেই পরীক্ষা বাতিল না করলে সমস্যার সমাধান কখনোই হবে না৷ এই যেমন বারবার মেডিকেলের প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠলেও কর্তৃপক্ষ সবসময় অস্বীকার করেছে৷

২০১৫ সালের মেডিকেল ও ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ ওঠার পর পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে তীব্র আন্দোলন করে পরীক্ষার্থী ও অভিবাবকরা৷ এর পরিপ্রেক্ষিতে একটি গণতদন্ত কমিটি গঠন করা হয়৷ পরবর্তীতে এই কমিটি ২০১৫-১৬ সেশনে মেডিকেল ও ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ সত্য বলে রিপোর্ট করে এবং নতুন করে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের সুপারিশ করে৷ কিন্তু কর্তৃপক্ষ সেটি করেনি৷ এভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ তো হয়ই না উল্টো ফাঁস হওয়া প্রশ্ন যারা পান, তারা বহাল তবিয়তে থাকেন৷ অথচ প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রমাণ মিললে, সেই পরীক্ষা বাতিল করলে, প্রশ্নপত্র ফাঁস কমবেই৷ এখানে স্বাস্থ্য দপ্তরের দায় এড়ানোর কোন সুযোগ নেই৷

আরেকটি বিষয়৷ যেহেতু সর্ষের মধ্যেই বারবার ভূত দেখা যাচ্ছে, কাজেই প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করতে হলে দায় নিতে হবে৷ এসএসসি, এইচএসসি থেকে শুরু করে যে কোনো ধরনের পাবলিক বা নিয়োগ পরীক্ষার নানা কাজের দায়িত্বে যারা থাকেন, ফাঁস হলে ব্যর্থতার দায় তাদেরও নিতে হবে৷ পাশাপাশি প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের বিরুদ্ধেও যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে৷ তাদের যেমন বিচার করতে হবে, তেমনি প্রয়োজনে তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে৷ কিন্তু আমাদের দেশে না বিচার না সম্পদ বাজেয়াপ্ত কোনোটাই হয় না৷

Shariful Hasan
শরিফুল হাসান, কলামিস্টছবি: Privat

আসুন, একটু আদালতে যাই৷ ২০০৯ থেকে ২০২১ সাল—এই ১৩ বছরে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় এসএসসি, এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে ভর্তি, বিভিন্ন চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার (ব্যাংক, বিসিএস ইত্যাদি) প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ পরীক্ষাসংক্রান্ত বিভিন্ন অভিযোগে মোট ২০০টি মামলা হয়েছিল৷ কিন্তু সাজার হার নগণ্য৷

২০২২ সালের ১৩ মার্চ প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৩ বছরে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনে করা ৪৫টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে৷ এগুলোর মধ্যে মাত্র ১টির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, শতকরা হিসাবে ২ দশমিক ২২ ভাগ৷ অর্থাৎ ৯৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ মামলার আসামিরা অব্যাহতি বা খালাস পেয়েছেন৷

অবশ্য আশার একটা ঘটনাও আছে৷ ২০২২ সালের ৩১ অক্টোবর রাজশাহী বিভাগীয় সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালত এক দিনে প্রশ্নপত্র ফাঁসের পৃথক নয়টি মামলার রায় দিয়েছেন৷ এর মধ্যে সর্বোচ্চ সাত বছরসহ আটটি মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে নয়জনকে সাজা ও অর্থদণ্ড দিয়েছেন আদালত৷

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস সাম্প্রতিক সময়ে আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে৷ যত বেশি ডিজিটাল সম্প্রসারণ হচ্ছে, তত বেশি ডিজিটাল অপরাধের প্রবণতা বাড়ছে৷ মানুষের হাতের মুঠোয় ইন্টারনেট–সুবিধা পৌঁছে যাওয়ায় এর অপব্যবহার করে একশ্রেণির প্রতারক চক্র প্রশ্নপত্র ফাঁসের নামে প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে৷ এ ধরনের কার্যক্রমের কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়াশোনার পরিবর্তে প্রশ্নপত্র পাওয়ার লোভ জাগ্রত হচ্ছে, যা সামগ্রিকভাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মেধা ও মননের জন্য হুমকিস্বরূপ৷

কথাগুলো ভীষণ সত্য৷ দেশের তরুণ প্রজন্মকে সুস্থভাবে বাঁচাতে হলে প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধের কোনো বিকল্প নেই৷ এজন্য পরীক্ষা-পদ্ধতি বদলানো যেতে পারে৷ যে কোনো পরীক্ষায় ৮ থেকে ১০ সেট প্রশ্নপত্র হওয়া উচিত৷ পরীক্ষার আগমুহূর্তে লটারি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে কোন প্রশ্নে পরীক্ষা হবে৷

তবে প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেই কাউকে না কাউকে দায় নিতে হবে৷ বিশেষ করে সর্ষের মধ্যে যে ভূত সেই ভূত তাড়াতে হবে৷ আর কোনো পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে সেই পরীক্ষা বাতিল করতে হবেই৷ আর প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের বিরুদ্ধে শুধু মামলা নয়, তাদের চিহিৃত করা ও তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে৷ একটা কথা মনে রাখতে হবে, সবার সম্মিলিত লড়াই ছাড়া প্রশ্নত্র ফাঁসের মতো মহামারি রোধ করা সম্ভব নয়৷ আরো দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই সেই লড়াইটা শুরু করতে হবে৷ রাষ্ট্রকেই এখানে সবার আগে দায়িত্ব নিতে হবে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য