1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

শিক্ষকরা কেন আন্দোলনে, শিক্ষানীতি কেন কাগজে?

শরিফুল হাসান
২৮ জুলাই ২০২৩

মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের (সরকারীকরণ) দাবিতে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছেন শিক্ষকেরা। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির ডাকে ১১ জুলাই থেকে এই কর্মসূচি চলছে।

https://p.dw.com/p/4UVez
কতটুকু মান অর্জন করলে সরকার বেতন ভাতা দেবে তার একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার দরকার ছিল।
কতটুকু মান অর্জন করলে সরকার বেতন ভাতা দেবে তার একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার দরকার ছিল। ছবি: Mortuza Rashed/DW

গত দুই সপ্তায় যারাই প্রেসক্লাবের সামনে গিয়েছেন, তারা দেখেছেন ক্লাসরুমের শিক্ষকরা রাজপথে স্লোগান দিচ্ছেন। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি আন্দোলন প্রত্যাহারের অনুরোধ থেকে শুরু করে কঠোর হওয়ার কথা জানালেও সাড়া দেননি বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এই শিক্ষকেরা। তাঁরা বলেছেন, এবার জাতীয়করণের সুস্পষ্ট ঘোষণা না আসা পর্যন্ত, কিংবা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎ না পাওয়া পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি চলবে।

এর আগে আন্দোলনরতদের ফেরাতে ক্লাসে অনুপস্থিত শিক্ষকদের তালিকা প্রতিদিন মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে তালিকা পাঠানোর জন্য জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের কাছে নির্দেশনা গেছে। বাতিল করা হয়েছে গ্রীস্মকালীন ছুটিও। কিন্তু তবু শিক্ষকদের টলানো যায়নি।

আন্দোলনের ১৬তম দিনে ২৬ জুলাই বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ কাওছার আহমেদ শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির উদ্দেশে বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ এই আন্দোলনকে বিভিন্নভাবে কটাক্ষ করে আপনি যেভাবে উসকে দিচ্ছেন, দয়া করে আর কোনো অস্তিত্বে আঘাত না দিয়ে শান্তিপূর্ণ অবস্থান থেকে শ্রেণিকক্ষে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। না হয়, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত শ্রেণিকক্ষে যাবো না।'

তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ নেই বলে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি জানিয়েছেন। ১৯ জুলাই তিনি আন্দোলনরত শিক্ষক ও অন্যান্য শিক্ষকসংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে মন্ত্রী বলেন, এ বিষয়ে (জাতীয়করণ) আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ নেই। তবে জাতীয়করণের যৌক্তিকতা আছে কি নেই, সেটাসহ শিক্ষা, শিক্ষকদের সার্বিক মানোন্নয়নের লক্ষ্যে দুটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। একটি কমিটি জাতীয়করণসহ শিক্ষা ও শিক্ষকদের মান্নোয়নের প্রয়োজনীয়তা, যৌক্তিকতা ও করণীয় বিষয়ে গবেষণা করবে। আরেকটি কমিটি আর্থিক বিষয়টি নিয়ে কাজ করবে। গবেষণাভিত্তিক এই দুই কমিটির প্রতিবেদনের পর এ নিয়ে পরবর্তী সময়ে করণীয় ঠিক করা হবে।

এর আগে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতেও বেসরকারি শিক্ষা জাতীয়করণের দাবিতে ১৫ দিন অনশন করেছিলেন বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকেরা। ওই সময়ও শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণসহ কয়েক দফা দাবিতে শিক্ষকেরা আন্দোলনে নেমেছিলেন শিক্ষা জাতীয়করণ লিয়াজোঁ ফোরামের নামে। কিন্তু কেন বারবার এই জাতীয়করণের আন্দোলন?

প্রায় দুই বছর করোনার অতিমারিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় লেখা-পড়ার অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। এই অবস্থায় শিক্ষকেরা ক্লাসরুমের বদলে কেন রাজপথে? জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে কোনো প্রতিশ্রুতি পেতেই কী এই চাপ? আর প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কলেজশিক্ষক, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও কেন সুযোগ সুবিধার জন্য এখানে আন্দোলন করতে হয়?

বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সারা দেশে মাধ্যমিকে মোট শিক্ষার্থী ১ কোটি ১ লাখ ৯০ হাজার ২২। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে ২০ হাজারের বেশি। এর মধ্যে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ৬৮৪টি। বাকিগুলো বেসরকারি। মোট শিক্ষক আছেন পৌনে তিন লাখের মতো। বেসরকারি

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অধিকাংশই এমপিওভুক্ত। এর মানে হলো, এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকার থেকে বেতনের মূল অংশসহ কিছু ভাতা পান। তবে সার্বিকভাবে তাদের সুযোগ-সুবিধা খুবই কম।

সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা একই সিলেবাসে শিক্ষার্থীদের পড়ান। কিন্তু তাঁদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা এক নয়। এমপিওভুক্ত বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সরকার থেকে মূল বেতন পুরোটাই পান। কিন্তু বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা ও উৎসব ভাতার ক্ষেত্রে আকাশ-পাতাল ফারাক।

সরকারি শিক্ষকেরা মূল বেতনের ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ বাড়িভাড়া পান। আর এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা পান মাত্র এক হাজার টাকা। সরকারি শিক্ষকেরা উৎসব ভাতা পান মূল বেতনের সমান। বেসরকারি শিক্ষকেরা পান মাত্র ২৫ শতাংশ। চিকিৎসা ভাতা দেওয়া হয় মাত্র ৫০০ টাকা। তাদের কোন পেনশন নেই, বদলি নেই।

এ তো গেল শুধু মাধ্যমিকের কথা। মাধ্যমিকের প্রায় ২০ হাজার প্রতিষ্ঠান ছাড়াও নয় হাজারেরও বেশি মাদ্রাসা এমপিওভুক্ত যেখানে এক লাখেরও বেশি শিক্ষক আছেন। কলেজ আছে অন্তত চার হাজার। সব মিলিয়ে দেশে প্রায় ৪০ হাজার এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেখানে পাঁচ লাখেরও বেশি শিক্ষক একই ধরনের বৈষম্য নিয়ে আছেন। এই বৈষম্য দূর করা প্রয়োজন।

আন্দোলনকারী শিক্ষকরা বলছেন, সরকার এমপিওভুক্তি বাবদ এখন বছরে এক হাজার ৪২৫ কোটি টাকা দেয়। জাতীয়করণ করলে আড়াই হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। কিন্তু এর বিপরীতে শিক্ষার্থীর ফি থেকে শুরু করে নানাভাবে যে আয় আসবে তাতে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে। সরকার নিশ্চয়ই বিষয়গুলো বিবেচনা করবে।

এটি সত্যি, দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষা খাতে বাংলাদেশে বরাদ্দ যেমন কম, তেমনি কম শিক্ষকদের বেতন-ভাতাও। এসব কারণেই এখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেধাবীরা এখন শিকক্ষতা পেশায় আসেন না, বিশেষ করে বেসরকারিতে। তবে বাংলাদেশের বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়াটাও যথেষ্ট ত্রুটিপূর্ণ। বিশেষ করে এমপিওভুক্তির নামে অনিয়মের উদাহরণ তো ভুরি ভুরি। এ প্রসঙ্গে সংস্কৃতি বিষয়ক সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের কথাগুলো মনে করা যেতে পারে।

২০১৮ সালের ২৭ জুলাই তিনি এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ”আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের জন্যে এমপিওভুক্তি চরমভাবে দায়ী। এমপিওভুক্তি যতটা না উপকার করেছে, তার চেয়ে বেশি করেছে অপকার। গণহারে স্কুল তৈরি ও শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের যোগ্যতা বিবেচনা করা হয়নি। কতটুকু মান অর্জন করলে সরকার বেতন ভাতা দেবে তার একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার দরকার ছিল। সেটি না করায় এর কুফল আমাদের ভোগ করতে হচ্ছে।”

এই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় সময় এসেছে এমপিওভুক্তি কতোটা অবদান রেখেছে তা নিয়ে গবেষণা জরুরী। বেতন ও সুযোগ সুবিধা কমন সেটা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু বাংলাদেশের মাধ্যমিক স্কুলগুলোর মান কেমন? কতোগুলো প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষা উপকরণ, লাইব্রেরি, বা গবেষণাগার আছে?

শরীফুল হাসান, এনজিও কর্মী ও অ্যাকটিভিস্ট
শরীফুল হাসান, এনজিও কর্মী ও অ্যাকটিভিস্টছবি: Privat

একই প্রশ্ন উঠতে পারে প্রাথমিক থেকে শুরু করে সব পর্যন্ত জন্য। শিক্ষার মান নিয়ে তো প্রশ্নের শেষ নেই। তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে কারিগরী শিক্ষা বা দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ার বদলে শুধুমাত্র জিপিএ-৫ নির্ভর বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাগুজে সনদ নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা কতোটা জরুরী? এমপিওভুক্তি, সারাদেশের কলেজগুলোতে গণহারে অনার্স চালুর পর এখন আবার জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় করা কতোটা সঠিক তা নিয়ে গবেষণা জরুরী।

মুক্তিযুদ্ধের পর কথা ছিল বাংলাদেশের শিক্ষা হবে একমুখী,সর্বজনিন ও অবৈতনিক। ড. কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টেও তা উল্লেখ ছিল। অথচ দেশে নানামুখী শিক্ষাব্যবস্থা। ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষা হবে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। আর মাধ্যমিক স্তর হবে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত। এ জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতাসম্পন্ন বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। কিন্তু শিক্ষানীতির এসব আজও বাস্তবায়ন হয়নি। এছাড়া সব স্তরের শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতনকাঠামো প্রণয়ন করার কথা বলা হয়েছিল। শিক্ষানীতি প্রণয়নের ১৩ বছর হতে চলল। এগুলো বাস্তবায়নে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। এমনকি শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে যে আইন করার কথা ছিল, সেটাও হয়নি। বরং জোড়াতালি দিয়ে সব চলছে।

প্রশ্ন হলো চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আর আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হবে, কারা শিক্ষক হবেন, তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া কী হবে, কোন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থায় জাতি আগাবে সেসব নির্ধারণ জরুরী। সবাইকে বিশ্ববিদ্যাালয়ে পড়তে হবে, সবাইকে সনদ নিতে হবে, এই ধারণা থেকে এখন বেরিয়ে আসা জরুরী। এখন সনদ নয় বরং দক্ষতাই জরুরী। কারিগরি, ব্যবসায়িক ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার উন্নয়ন ছাড়া দেশ আগাতে পারবে না। অথচ বাংলাদেশ লাখ লাখ ছেলেমেয়ে সনদ নিয়ে বের হচ্ছে যারা একটা চাকুরির জন্য হাহাকার করছে।

গবেষণা সংস্থা বিআইডিএসের বছর দুয়েক আগের এক জরিপে উঠে এসেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬৬ শতাংশই বেকার। ফলে চাহিদার তুলনায় কর্মসংস্থান কম থাকায় শিক্ষিতদের বড় একটি অংশ হতাশায় ভুগছেন। অনেকে আবার আত্মহননের মতো ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্তও গ্রহণ করেছেন।

তথ্য বলছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোতে এখন মোট শিক্ষার্থী আছেন ২০ লাখের মতো, আর সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে অধিভুক্ত কলেজ আছে ২ হাজার ১৫৪টি। এগুলোর মধ্যে ২৭৯টি সরকারি কলেজ। সম্মান পড়ানো হয় এ রকম সরকারি-বেসরকারি কলেজের সংখ্যা ৫৫৭।

শুধু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশে প্রতিনিয়ত সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ছে। ১০ বছর আগেও বছরে দুই থেকে আড়াই লাখ শিক্ষার্থী স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পাস করে চাকরির বাজারে যুক্ত হতেন। এখন সেই সংখ্যা বেড়ে চার-পাঁচ লাখে উন্নীত হয়েছে। আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বেশির ভাগ শিক্ষিত চাকরিপ্রার্থী শহর ও শোভন কাজ করতে চান। কিন্তু শহরে যত চাকরিপ্রার্থী প্রতি বছর তৈরি হচ্ছে, সেই পরিমাণ চাকরির সুযোগ তৈরি হচ্ছে না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপে দেখা গেছে, দেশে শিক্ষিত মানুষের মধ্যেই বেকারের হার বেশি। ৪৭ শতাংশ শিক্ষিতই বেকার। দেশে প্রতিবছর শ্রমশক্তিতে যোগ হচ্ছে ২০ লাখ মানুষ। কিন্তু সেই অনুপাতে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। ফলে বড় একটি অংশ বেকার থেকে যাচ্ছে। কাজেই শিক্ষা নিয়ে আমাদের সত্যিকারভাবে ভাবতে হবে। শুধুমাত্র সনদধারী গ্রাজুয়েটের সংখ্যা বৃদ্ধি না করে দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষিত জনবল গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে তারা শিক্ষায় যতটা উন্নত, তার চেয়ে বেশি উন্নত যুগোপযোগী শিক্ষায়, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায়। সুইজারল্যাণ্ড, জার্মানি, জাপান, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, চীন, দক্ষিণ কোরিয়ায় অধিকাংশ মানুষ আমাদের মতো মূল ধারার বদলে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত ও দক্ষ। অথচ বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের তথ্যমতে, ২০১৮ সালে কারিগরি শিক্ষার হার ১৪ শতাংশ। তরুণ প্রজন্মের দক্ষতা বাড়াতে গেলে সমাজে কারিগরি শিক্ষা নিয়ে যে সামাজিক ট্যাবু আছে সেটি ভাঙতেই হবে।

জাতীয় শিক্ষা নীতি অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষা যদি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত হয় এরপর কারিগরী শিক্ষার দিকে একটা বড় অংশ চলে যেতে পারে। এখানেও দক্ষ শিক্ষক জরুরী। দক্ষ শিক্ষক থাকলে দক্ষ তরুণ প্রজন্ম তৈরি হবে যারা দেশে ও বিদেশে সব জায়গাতেই নিজেদের প্রমাণ করতে পারবেন।

এখানে প্রবাসী কর্মীদের বিষয়টি চলে আসে। বাংলাদেশের এক কোটিরও বেশি লোক প্রবাসে। কিন্তু এদের বেশিরভাগই অদক্ষ। ফলে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি করে বাংলদেশিরা। অন্যদিকে তুলনামূলক দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি করায় বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের প্রবাসী আয়ের পরিমাণ অনেক বেশি। ভারতের মতো বাংলাদেশও যদি দক্ষ লোক পাঠাতে পারতো তাহলে বছরে ৩৫ থেকে ৪০ বিলিয়ন ডলারের প্রবাসী আয় আসতে পারে যেটি এখন ২০ থেকে ২২ বিলয়নে আটকে আছে।

আবার দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরির পাশাপাশি দক্ষ উদ্যোক্তাও তৈরি করতে হবে যাতে একজন উদ্যোক্তা অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেন। এ জন্যও যথাযথ প্রশিক্ষণ দরকার। আসলে সত্যিকারের শিক্ষক বা প্রশিক্ষক না থাকলে উন্নত জাতি গড়ে তোলা কঠিন। আর দক্ষ ও মেধাবী শিক্ষক পেতে হলে ভালো বেতন-ভাতা দিতে হবে যেন সবাই শিক্ষকতা পেশায় আসতে আগ্রহী হয়। এখানে যদি নানা ধরনের বৈষম্য থাকে আর সেই বৈষম্যের বিরুদ্ধে শিক্ষকরা ক্লাসরুমের বদলে রাজপথে থাকবেন যেটি দেশ জাতি কারো জন্যই মঙ্গলজনক নয়।

শিক্ষাকে বলা হয় একটা জাতির মেরুদণ্ড। সেই মেরুদণ্ড ভালো না হলে দেশের অগ্রগতি কঠিন। কাজেই একটা দেশের প্রাথমিক থেকে শুরু করে মাধ্যমিক, কারিগরী বা উচ্চ শিক্ষাব্যবস্থা কী হবে, কতো ধরনের শিক্ষা একসঙ্গে চলবে নাকি একমুখী শিক্ষা হবে, কীভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ হবে, তাদের বেতন কাঠামো কেমন হবে এগুলো ঠিক করা জরুরী।

অবার গণহারে মানহীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে এমপিওভুক্তি কিংবা জাতীয়করণে কী লাভ হয়, কলেজে কলেজে অনার্স আর জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় খোলা জরুরী নাকি কারিগরী শিক্ষা, গণহারে জিপিএ-৫ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাখ লাখ শিক্ষার্থীর কাগুজে সনদ কোনটা জরুরী সেগুলো ভাবতে হবে। সার্বিকভাবে জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী শিক্ষার একটা টেকসই কাঠামো না দাঁড়ালে এমন সংকট চলতেই থাকবে। সবমিলিয়ে সরকারের এমন উদ্যোগ নেওয়া উচিত যাতে শিক্ষকদের কয়েক বছর পর আবার রাজপথে নামতে না হয়। আবার মানসম্মত শিক্ষা ও শিক্ষকেরও কথাও ভাবতে হবে। এই দুটোই যে পরষ্পরের পরিপূরক!

শিক্ষামন্ত্রী জাতীয়করণসহ শিক্ষা ও শিক্ষকদের মানোন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা, যৌক্তিকতা ও করণীয় বিষয়ে যে গবেষণার কথা বলেছেন তাতে নিশ্চয়ই বিষয়গুলো উঠে আসবে। তবে এই মুহুর্তে সবার আগে জরুরি শিক্ষকদের ক্লাসে ফেরানো। আর সেই দায়িত্ব তো সরকারকেই নিতে হবে!